ডেস্ক রিপোর্ট:কেমন ছিলো সেদিনের বিকেলটি। শীত জর্জর সেই বিকেলে কুয়াশার চাদর ঝুলে ছিলো নিশ্চয়ই মাথার ওপর। ২৩ বছরের দীর্ঘ যাত্রায় টগবগ করে ফোঁটা রেসকোর্স ময়দান নয় মাস নীরবে বিছিয়ে থেকে সেই বিকেলে জেগে উঠেছিলো আড়মোড়া ভেঙে- একটি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জনের সাক্ষী হতে। আর নিজ নগরে পরবাসী হয়ে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে ছিলো কেমন উত্তেজনা! আজ এই পঞ্চাশ বছরে এসে সেই মহিমান্বিত গৌরবের সাক্ষী হতে না পারা, সেই অমিত অর্জনকে চাক্ষুস করতে না পারা মানুষের পক্ষে কি তা উপলব্ধি করা সম্ভব?
১৬ই ডিসেম্বর একাত্তরের সেই বিকেলে যারা ছিলেন সেদিনের রেসকোর্স আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাদের মতো সৌভাগ্যবান আর কেউ কখনো জন্ম নেবে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই ভূখণ্ডে?
পরাজয় অনিবার্য জেনে ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজিকে যুদ্ধ বন্ধ এবং সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। সেদিন বিকেলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব পাঠান নিয়াজি। অন্যদিকে রাও ফরমান আলীর শীতল নকশায় নয় মাস ধরে চলা বুদ্ধিজীবী হত্যা চূড়ান্ত মাত্রা পায় এদিন। আর ১৫ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে অস্ত্র সংবরণ করে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল হামিদ আত্মসমর্পণে সম্মত হতে সবুজ সংকেত দেন নিয়াজিকে। মানেকশ নিয়াজিকে প্রস্তাব গ্রহণ ও কার্যকর করার জন্য ১৫ই ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটা থেকে পরের দিন সকাল নয়টা পর্যন্ত যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করেন। পরে এই মেয়াদ বেলা তিনটা পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
১৬ই ডিসেম্বর সকাল সোয়া নয়টায় মানেকশ ভারতের পূর্বাঞ্চল বাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জেকবকে আত্মসমর্পণের দলিল ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা চূড়ান্ত করার জন্য ঢাকায় পাঠান। আলোচনাকালে নিয়াজি আত্মসমর্পণের বদলে যুদ্ধবিরতি লেখার প্রস্তাব দিলে তা নাকচ করে দেন জেনারেল জেকব। এরই মধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মানসিক পরাজয় হয়ে গেছে। তাই আত্মসমর্পণের দলিলে নিয়াজির মত পেতে বেগ পেতে হয়নি জে এফ আর জেকবকে। অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর বিকেলে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী। ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল চারটা একত্রিশ।কি ছিলো সেই দলিলে? আত্মসমর্পণের সেই দলিলের বাংলা তরজমা নিচে দেয়া হলো:
আত্মসমর্পণের দলিল, ঢাকা ১৬৩১ ঘণ্টা (আইএসটি), ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সকল সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণে সম্মত হলো। পাকিস্তানের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীসহ সব আধা সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেত্রে এই আত্মসমর্পণ প্রযোজ্য হবে। এই বাহিনীগুলো যে যেখানে আছে, সেখান থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কর্তৃত্বাধীন সবচেয়ে নিকটস্থ সেনাদের কাছে অস্ত্র ও আত্মসমর্পণ করবে।
এই দলিল স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার নির্দেশনাধীন হবে। নির্দেশ না মানলে তা আত্মসমর্পণের শর্তের লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে এবং তার প্রেক্ষিতে যুদ্ধের স্বীকৃত আইন ও রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যাবে। আত্মসমর্পণের শর্তাবলীর অর্থ অথবা ব্যাখ্যা নিয়ে কোনো সংশয় দেখা দিলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আত্মসমর্পণকারী সেনাদের জেনেভা কনভেনশনের বিধি অনুযায়ী প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান দেয়ার নিশ্চয়তা দিচ্ছেন এবং আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সামরিক ও আধা সামরিক ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ও সুবিধার অঙ্গীকার করছেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধীন বাহিনীগুলোর মাধ্যমে বিদেশি নাগরিক, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও জন্মসূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যক্তিদেরও সুরক্ষা দেয়া হবে।
জগজিৎ সিং অরোরা
লেফটেন্যান্ট জেনারেল
জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ
পূর্ব রণাঙ্গনে ভারত ও বাংলাদেশ যৌথ বাহিনী
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি
লেফটেন্যান্ট জেনারেল
প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, অঞ্চল বি
কমান্ডার, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড, পাকিস্তান ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১