স্তন ক্যান্সার মরণব্যাধি হলেও সচেতন হয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করে চিকিৎসকের কাছে আসলে নিরাময় সম্ভব। এজন্য নিজে নিজে পরীক্ষার পাশাপাশি রয়েছে আল্ট্রাসনোগ্রাম বা মেমোগ্রাম পদ্ধতি।এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জিক্যাল অনকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কৃষ্ণা রূপা মজুমদার বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্তন ক্যান্সার নারীদের আর পুরুষদের প্রোস্টেট ক্যান্সার বা ফুসফুসের ক্যান্সার এবং সবার ক্ষেত্রে ওরাল ক্যান্সারটা বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। নারীদের ক্ষেত্রে স্তন ক্যান্সার এবং জরায়ুর ক্যান্সারটা প্রথম স্থানে। তাহলে, কিভাবে আমরা এটাকে প্রতিরোধ করবো? এটা তো আসলে অনেক বড় একটা ইস্যু আমাদের ক্ষেত্রে।
তিনি বলেন, শুধু সেমিনার বা সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে বা পত্রিকার মাধ্যমে কয়জনের দোরগোড়ায় আমরা এটাকে পৌঁছিয়ে দিতে পারি? আর স্তন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে রোগীরা অনেকসময় সচেতনতার অভাবে লজ্জা অনুভব করে চিকিৎসকের কাছে আসছেন না। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, দীর্ঘ ১ বছর সময়ে যারা অন্যান্য ক্যান্সার রোগী তারা হয়তো সচেতন ছিল। কিন্তু যাদের স্তনে একটা চাকা হয়েছে, তারা লজ্জা কাটিয়ে উঠে ডাক্তারের কাছে আসতে চাইলেও, করোনা কিন্তু একটা বিরাট দেয়াল হয়ে তাদের সামনে দাঁড়িয়েছে। সেক্ষেত্রে তারা একটা সময় স্বামীকেই বলেন এবং তারাই স্ত্রীদের সচেতন করেন এবং চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো এর ব্যতিক্রম দেখা যেতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসকের শরণাপণ্ন হলে এটা সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। এজন্যই আমরা বলে থাকি, ‘আর্লি ডিটেকশন সেভস লাইফ’। ক্যান্সার মানেই যে মরণব্যাধী এ রকমটা মনে করার কিছু নেই। তবে সেটা সম্পূর্ণ নিরাময় করার জন্যে অবশ্যই স্তন ক্যান্সারের প্রাথমিক পর্যায়েই চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে এবং ধাপে ধাপে এটার সম্পূর্ণ চিকিৎসাটা নিতে হবে।
স্তন ক্যান্সার রোগীদের কখন চিকিৎসকের কাছে আসা উচিত?
এ ব্যাপারে ডা. কৃষ্ণা রূপা মজুমদার বলেন, যেসব পরিবারে স্তন ক্যান্সার বা ওভারিয়ান ক্যান্সারের ইতিহাস আছে, সেসব পরিবারের সদস্যদের ৩০ বছর বয়স থেকেই স্ক্রিনিং-এর আওতায় আসতে হবে। আর যাদের পারিবারিক ইতিহাস নেই, তাদের স্তনে চাকা হলে নিপল দিয়ে রসজাতীয় পদার্থ বের হয় বা নিপলের ভিতরে ঢুকে গেলে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। অনেকে আবার চাকা বুঝতে পারেন না। যেমন, যারা একটু বেশি স্বাস্থ্যবান, যাদের ব্রেস্ট একটু হেভি বা যারা কনসিভ করেছেন অথবা ল্যাক্টিটিং মাদার (দুগ্ধবতী মা) তারা অনেক সময় চাকা বুঝতে পারেন না।
গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে স্তনে অনেক পরিবর্তন আসতে পারে। যে কারণে চাকা থাকলেও বুঝা যায় না। তাই যারা কনসিভ করছেন বা করবেন তারা অবশ্যই স্তনে কমপক্ষে একটা আলট্রাসনোগ্রাম করিয়ে নিবেন, যাতে স্তন ক্যান্সার থাকলে সেটা বুঝা যায়। স্তন ক্যান্সারের যে চাকাটা সেটা কিন্তু ব্যাথা সৃষ্টি করে না। তাই এটা গুপ্তঘাতকের মতো আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। যখন অনেক বড় হয়ে যায়, স্কিন ধরে ফেলে, নিপল দিয়ে রস বের হয়। তখন সেটা ব্যাথার সৃষ্টি করে। তারমানে সেটা তখন ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সেজন্য বাচ্চা হওয়ার আগে ও পরে একটা অন্তত আল্ট্রাসনোগ্রাম করা উচিত। মেমোগ্রাম করিয়ে রেডিয়েশন নেওয়ার দরকার নাই। যদিও মেমোগ্রাম অনেক লো রেডিয়েশনের একটা টেস্ট।
তাছাড়া, ৫০ বছরের পরে একবার চিকিৎসকের কাছে এসে আল্ট্রাসনোগ্রাম এবং মেমোগ্রাফিটা অবশ্যই করা উচিত। আর যারা স্তন বিশেষজ্ঞ তারা সাধারণ একটা মেমোগ্রাফি দেখলে ক্যান্সার না থাকলেও যদি সেটা পরে হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাও বুঝতে পারেন।
স্তনে চাকা অনুভব করলে পরীক্ষাটা কীভাবে করা সম্ভব?
এ ব্যাপারে ডা. কৃষ্ণা রূপা মজুমদার বলেন, সেলফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন বা এসব প্রক্রিয়াটা যদি আমরা সব নারীর দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারতাম বা তাদের শিখাতে পারতাম, তাহলে এই স্তন ক্যান্সারের আক্রান্তের সংখ্যাটা না কমলেও তারা আমাদের কাছে প্রাথমিক পর্যায়ে আসতে পারতো। এই পরীক্ষাটা খুব সহজ এবং যেকোনো নারীই তার গোসলের সময় বা ওয়াশরুমে গেলে এটা নিজে নিজেই পরীক্ষা করতে পারে। এ ধরণের চাকা হলে সেটা কোনো নারী তার ম্যামারি গ্ল্যান্ড বা স্তনকে যদি ক্লক-ওয়াইজ বা অ্যান্টিক্লক-ওয়াইজ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে স্পর্শ করে তাহলে অবশ্যই একটা অস্বাভাবিক কিছু টের পাবেন। এই পরীক্ষাটা করার সময় হাতের তালু বাকা না করে সোজাভাবে রাখতে হবে। বৃদ্ধাঙ্গুল বাদে বাকি চারটা আঙুল একসাথে করে স্তনে চাপ দিয়ে দেখতে হবে অস্বাভাবিক কিছু বোঝা যায় কিনা। এটা যেকোনো সময় করা যায়। তবে মাসিকের ৭ দিন আগে বা ৭ দিন পরে এই পরীক্ষাটা করলে, স্তনে কোনো চাকা থাকলে সেটা তখন গুরুত্বসহকারে বুঝা যায়।
এছাড়াও, সাবান পানিতে একটু ভিজিয়ে স্তনের চারপাশে যদি সার্কেল করে, তাহলেও অস্বাভবিকতা বা চাকা থাকলে সেটা বোঝা যায়। এই পরীক্ষাগুলো সাধারণত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে করলে ভালো বোঝা যায়। আর বেশীরভাগ ক্ষেত্রে রোগীরাই এসে বলেন স্তনে চাকা হয়েছে। সেক্ষেত্রে তারাই ডায়াগনোসিস করে আসেন এবং সেটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই পালন করে। সেকারণেই তাদেরকে এই জ্ঞানটা দেওয়া দরকার, তাহলে তারা স্তন ক্যান্সারের অনেক প্রাথমিক পর্যায়ে নিজেই বুঝতে পারবেন এবং চিকিৎসকের কাছে আসবেন। আর তখন আমরাও সেটাকে খুব সহজেই সম্পূর্ণ নিরাময় করতে পারবো।
সূত্র: ডক্টর টিভি