নিজস্ব প্রতিবেদক : ভয়াল ২১ আগস্ট আজ থেকে ১৭ বছর আগে এ দিনে ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে ‘সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিবিরোধী’ এক সমাবেশের আয়োজন করেছিল ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ। দিনটি ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। সমাবেশে একটি খোলা ট্রাকে (ঢাকা মেট্টো-ট-১১-৩০৯৮) বানানো হয়েছিল উন্মুক্ত মঞ্চ।
বিকেল ৫টায় সমাবেশস্থলে আসেন বঙ্গবন্ধুকন্যা ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ট্রাকে তার সঙ্গে ছিলেন জিল্লুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল জলিল, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কাজী জাফরউল্লাহ, মোহাম্মদ হানিফ ও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ আরও কয়েকজন কেন্দ্রীয় ও মহানগরী নেতানেত্রী।
ঠিক সেই সময় মঞ্চের দক্ষিণ পাশ থেকে ছোড়া একটি গ্রেনেড এসে পরে মঞ্চের ঠিক পাশেই। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয় গ্রেনেড। একই পাশ থেকে একে পর এক গ্রেনেড নিক্ষেপ করে হামলাকারীরা। মাত্র দেড় মিনিটের ব্যবধানে ১৩টি গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটে। সেসময় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে ঘিরে মানব দেয়াল তৈরি করে ফেলেন। পরে তাকে ধরে ট্রাকের মঞ্চ থেকে দ্রুত নামিয়ে তার মার্সিডিজ বেঞ্জ (বুলেট প্রুফ) গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়।
হামলায় ওই সমাবেশে থাকা আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নারী নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন কয়েকশ’ মানুষ। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রাঙ্গণ মুহূর্তেই পরিণত হয়েছিল মৃত্যুপুরীতে। কার্যালয়ের সামনে পড়েছিল অগনিত রক্তমাখা জুতা। সেদিনের ওই হামলায় প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেডের বিকট শব্দে বঙ্গবন্ধুকন্যার দুই কান ও চোখ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপূরণীয় ক্ষতি হয় তার শ্রবণশক্তির।
হামলায় আহতদের চিৎকার-আহাজারি, রক্তাক্ত নেতাকর্মীদের ছুটোছুটিতে পুরো এলাকা বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে। চারদিকে ছোপ ছোপ রক্ত আর মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহ। বিচ্ছিন্নভাবে পড়ে ছিল জুতা, সেগুলো ছিল রক্তে লাল। গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনায় এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায়, অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেটকার, বেবিট্যাক্সি, এমনকি রিকশা-ভ্যানে করেও আহতদের প্রথমে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। এ সময় অনেককে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে থেকে সাহায্যের জন্য আকুতি জানাতে দেখা যায়। দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ আহতদের সহায়তা ও হাসপাতালে নিতে এগিয়ে এলেও তখন পুলিশের ভূমিকা নিরবই ছিল।
এ ঘটনায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক জিয়া, চারদলীয় জোট সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম পিন্টু, হরকাতুল জিহাদ প্রধান মুফতি হান্নান ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ৫২ জনকে আসামি করা হয়।
এরপর এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার তদন্তে শুরু হয় নানান নাটকীয়তা। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার নানা চেষ্টা হয়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে পর প্রাণ ফিরে পায় মামলাটি। বেশ কয়েকবার বাঁক বদলের পর বেরিয়ে আসতে থাকে আসল রহস্য। মূলত আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে বিএনপি-জামায়াত তথা চার দলীয় জোট সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ইতিহাসের নৃশংসতম এ গ্রেনেড হামলা চালায়।
দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন আলোচিত গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণা করেন।
ভয়ংকর সেই গ্রেনেড হামলা ও হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় মোট ৫২ জন আসামির মধ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেন। একইসঙ্গে বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয় অপর ১১ আসামিকে।
বাকি তিনজনের মধ্যে হুজি-বি নেতা মুফতি হান্নান ও শরীফ শাহেদুল আলমের ফাঁসি কার্যকর হয় ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায়। আরেক আসামি জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হয় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায়। তাই তাদের এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
আসামিদের মধ্যে লুৎফুজ্জামান বাবর এবং আব্দুস সালাম পিন্টুসহ অনেকেই বর্তমানে কারাগারে আছেন। রায় ঘোষণার সময় তারেক রহমান এবং হারিছ চৌধুরীসহ ১৮ জনকে মামলার নথিতে পলাতক দেখানো হয়েছিল। পরে পুলিশের সাবেক ডিআইজি খান সাইদ হাসান এবং ডিএমপির সাবেক উপকমিশনার ওবায়দুর রহমান খান আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। সর্বশেষ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে যাবজ্জীবন দষ্ডপ্রাপ্ত ইকবাল নামে এক জঙ্গিকে গ্রেফতার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এর ফলে সর্বশেষ পলাতক রয়েছেন ১৫ জন, তাদের মধ্যে অন্তত নয়জন বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।