শেখ আনোয়ার
আমাদের দেশে লাউ কিংবা কুমড়া গাছে থাকা জোনাকি পোকার মতো গুবরে পোকার বংশজাত এক ধরণের পোকা রয়েছে। এর নাম বিটল। আর্থ্রোপ্রোডা প্রজাতির এই পোকার কারাপাস নামের খোলকের অফুরন্ত রূপ-বৈচিত্র্যের জন্য গ্রাম-বাংলায় বলা হয় কাঁচ পোকা।
এদের বর্ম পোকাও বলা হয়। ফিনফিনে ডিম্বাকৃতির ছোট দেহটা সব সময় ঢাকা থাকে একজোড়া কঠিন ডানা বা বর্মের আড়ালে। এই বর্ম রক্ষা করে গোটা প্রাণিটাকে। অ্যান্টার্কটিকার বরফ আর সাগর-মহাসাগর বাদে দুনিয়ার সবখানে মেলে এই পোকা।
পৃথিবীজুড়ে এই পোকার ১৫ হাজার প্রজাতি দেখা যায়। এই পোকা দেখে বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের মতো ব্যক্তিত্বও চমকে উঠেছিলেন বলে জানা যায়।
সত্যি কি দামি পোকা?
সাধারণত এই পোকা লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি, সবুজ ইত্যাদি রঙের হয়ে থাকে। তবে সোনালি রঙের দামি এই পোকা বেশি দেখা যায় হন্ডুরাসের পার্বত্যাঞ্চলে। হন্ডুরাসে পোকাটা পরিচিত জুয়েল স্ক্যার্যাব নামে। যখন এরা জঙ্গলের কোনো স্থান দিয়ে ঝাঁক বেঁধে উড়ে যায়, তখন এদেরকে দেখে মনে হয় কে যেন একরাশ সোনালি রঙের ঝলমলে জড়ির কাগজের কুঁচি উড়িয়ে দিয়েছে হাওয়ায়। হন্ডুরাসের জঙ্গলের স্ক্যারাবদের কেনো জুয়েল বলা হয়? এই পোকা কতটা দামি? সত্যি কি এদের জুয়েলের পর্যায়ে ফেলা যায়?
সোনার পোকায় কতটা সোনা?
জ্বি, হ্যাঁ। অবাক হলেও সত্যি, সংগ্রাহকরা সোনার চেয়েও বেশি অর্থ মূল্য দিয়ে কেনেন জুয়েল স্ক্যারাব। পৃথিবীতে এই সোনালি রঙের মহামূল্যবান গুবরে পোকার বৈজ্ঞানিক নাম ‘ক্রাইসিনা রিসপ্লেন্ডেনস’। সোনালি রঙের এক ভরি জুয়েল স্কারাবের বর্ম বা পাখার দাম ২০০ ডলার বা ষোলো হাজার টাকা মাত্র। এতো দামের কারণ কি?
এদের ডানা ও মাথায় যে প্রকৃতি প্রদত্ত রঙের আস্তরণ রয়েছে তা সত্যিই দুর্লভ। নিখাদ সোনার রঙ। দেখতে আসল সোনার মতো। চমৎকার চোখ ঝলসানো সৌন্দর্য সত্যিই যেন অবাক করা এক ফ্যান্টাসি। এই রঙ অন্য কোনো গাছপালা বা জীবজন্তুর হয় না। সেজন্য এই রঙ মানুষকে আজও অবাক ও বিস্মিত করে, ভাবিত করে।
বিজ্ঞানীরা বলেন, ‘এই সোনালি স্ক্যারাবের রঙ অরিজিনাল ও অদ্বিতীয় প্রাকৃতিক রঙের সিগনেচার। একে বলে ব্রিলিয়ান্ট গোল্ডেন রঙ। এই রঙ ধাতুযুক্ত। এজন্য একে ধাতব গুবরে পোকাও বলা হয়। এদের গায়ে আলো ফেলা হলে আলো ঠিকরে প্রতিফলিত হয়।’
মহাশূন্যে পোকাটা কতটা টেকসই?
কোস্টারিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ড. ইভান ফিনলেজনের মতে, ‘জুয়েল স্ক্যারাবদের মূল্য শুধু পোকার শক্ত খোলকের পাখার সোনালি রঙের জন্য নয়। এই পোকার ধাতব খোলকের আলো প্রতিফলনের ক্ষমতা আধুনিক ন্যানো প্রযুক্তির এক বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত। আলো প্রতিফলনের ক্ষমতা পর্যবেক্ষণে জুয়েল স্ক্যারাব আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পাঠানো হবে।
স্যাটেলাইট ও অন্যান্য মহাকাশ যানের রূপান্তরিত হালকা যন্ত্রাংশ হিসেবে মূল্যায়নের গবেষণা হবে।’ ইতোমধ্যে জুয়েল স্ক্যারাবের প্রাকৃতিক উজ্জ্বল রঙের উজ্জ্বলতা মহাশূন্যে কতটা টেকসই, মহাকাশে গিয়ে এই পোকা চলাফেরা করতে পারে কি-না?
তা জানতে সফল গবেষণা ও পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। এর আগে আবহাওয়া বেলুনে করে ৮,৩০০ মিটার উঁচুতে এই পোকা পরিবহন করে প্রথম সফল হন বিজ্ঞানীরা। এরপর বিজ্ঞানীরা ছোট শক্তিশালী রকেটে করে মহাকাশে পাঠিয়ে মাসের পর মাস ক্ষুদ্র এই পোকার মৌলিক আচরণ পর্যবেক্ষণ করে সফল হয়েছেন ।
এই পোকা কারা কেনে?
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাক্সিটার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের স্ক্যার্যাব সরবরাহকারী হিসেবে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্ব কেনমোনা। তিনি বলেন, ‘জুয়েল স্ক্যারাবদের দেখলে মনে হয় এগুলো নিখাদ সোনা দিয়ে তৈরি। চকচকে উজ্জ্বল থেকেও উজ্জ্বলতর সোনার রঙের জুয়েল স্ক্যারাব সংগ্রাহকদের নিকট ব্যাপক মূল্যবান। এগুলো বেশির ভাগই কিনে নেয় নামি-দামি বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রগুলো। এসব রঙিন স্ক্যারাবদের গবেষণাগারে ব্যবহার করা হয় ও ডিসপ্লে হিসেবে রাখা হয়।
এখন মহাকাশ গবেষণায়ও কাজে লাগানো হচ্ছে বিস্ময়কর এই পোকা।’ পোকার দেহের উপরের কাঠামো বা মসৃণ পাখনা দিয়ে তৈরি হচ্ছে দামি জুয়েলারি অলঙ্কার, কানের দুল, আংটি, শার্টের ফ্যাশনেবল বোতাম, কোটপিন, টাইপিন, গলার রিং ও নানাবিধ সৌখিন শিল্পকর্ম। গবেষকরা জানিয়েছেন, পোকার দেহের সোনালি খোলক মিসরের পিরামিডের মমির ব্যান্ডেজের কাজে ব্যবহার করা হতো।
এখনো এই জুয়েল স্ক্যারাব প্রাচীন মিশরীয় সংস্কৃতিতে ধর্মের পবিত্র অনুষ্ঠানে প্রার্থনার অনুষঙ্গ হিসেবে দরকার হয়। এছাড়াও এই পোকার অন্যজাতের নাম ক্রাইসো করিস স্টলি। এদের শক্ত খোলকের পিঠ সবুজ, উজ্জ্বল রক্ত লাল, বাদামিসহ বিভিন্ন উজ্জ্বল রঙের হয়ে থাকে। এগুলো পেট থেকে সম্পূর্ণ দেহ পাখা দিয়ে দু’ভাগ করে আবৃত থাকে।
এসব পোকার ফসিল বা পাখনা দিয়েও তৈরি হয় সাশ্রয়ী মূল্যের নেকলেস, চাবির রিং, কুটির শিল্পকর্ম, বা চিত্রকর্ম, ওয়াল পেইন্টিং, বিজ্ঞান প্রজেক্ট, ব্যক্তিগত সংগ্রহ এবং নানাবিধ সৃজনশীল ডেকোরেশন। বাজারে এগুলোর দাম তুলনামূলক সস্তা। প্রতি ভরির মূল্য ৫০ ডলার বা ৪ হাজার টাকা মাত্র।
পোকার রঙ এতো উজ্জ্বল কেনো?
বিজ্ঞানীদের মতে, ‘জুয়েল স্ক্যারাবদের কঙ্কাল কাঠামো পুরোটাই প্রাকৃতিক ন্যানো কাঠামোর। এই ন্যানো কাঠামোই বৃত্তাকারে আলো প্রতিফলনে ম্যাজিকের মতো কাজ করে থাকে। এই রঙে রয়েছে প্রাকৃতিক উপাদান চিটিন এবং বিভিন্ন ধরনেরর প্রোটিনের মিশ্রণ। যা অতি উজ্জ্বলতা ছড়ায়।’ জুয়েল স্ক্যারাবের বিশেষজ্ঞ যুক্তরাষ্ট্রের সেন্সরি ইউনিভার্সিটি অব অ্যাক্সাটার এর প্রফেসর পিটি ভুকসিক অ্যাস এখন বিভিন্ন ধরনের জুয়েল স্ক্যারাব নিয়ে গবেষণা করছেন।
তিনি বলেন, ‘এই পোকার সোনালি রঙের উজ্জ্বলতার কারণ- এদের দেহের শক্ত খোলক। যা পোলারাইজ রিফ্লেকশন সৃষ্টি করে। পোলারাইজড ত্রিডি চশমার মতো আলো প্রতিফলিত করে। এদের গায়ের রঙের দিকে তাকালে মানুষ বা অন্য প্রাণির চোখের অপটিক্যাল সেন্সর প্রযুক্তি ভোতা হয়ে যায়। এই পোলারাইজেশন একটা প্রাকৃতিক সিগনেচার।’ সারাবিশ্বে সংখ্যায় অনেক সবুজ স্ক্যারাব সবখানে পাওয়া গেলেও তাদের থেকে পোলারাইজড আলো বিচ্ছুরিত হয় না। বিবর্তন বাস্তুতত্বের অধ্যাপক ড. মার্টিন স্টিভেন্ডের মতে, ‘এরা শত্রুর চোখে ধুলো দেয়ায় খুব ওস্তাদ।
উজ্জ্বল সোনালি রঙের আলোর প্রতিফলন ঘটিয়ে এই পোকারা আত্মরক্ষা করে। অনুসরণকারী শত্রু প্রাণির চোখ ঝলসে দিয়ে আত্মরক্ষায় জন্য ক্যামোফ্লেজ করে। উল্লেখ্য, অন্য ক্ষুদ্র পতঙ্গ লাল, সবুজ, হলুদ রঙ আলাদা করতে পারলেও সোনালি রঙ আলাদা করতে পারে না। তাই এরা বুঁদ হয়ে কোথাও পড়ে থাকলেও সহজে দেখা যায় না।
কিভাবে চেনা যায় দামি পোকা?
সাধারণ গুবরে পোকা সহজেই চেনা যায়। কিন্তু জুয়েল স্ক্যারাব কিভাবে চেনা যায়? জুয়েল স্ক্যারাব আকৃতিতে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যময়। জুয়েল স্ক্যারাবদের পিঠের ঢাল বা খোলসের বিভক্তি চিহ্ন খালি চোখে প্রায় দেখাই যায় না। আর্থ্রােপোডা প্রজাতির অন্য পতঙ্গের মতোই এদের সমস্ত ক্রিয়াকর্ম চলে ধীরগতিতে। দৈর্ঘ ও প্রস্থের ০.০৮ ইঞ্চি থেকে ৬.৭ ইঞ্চি বা অনধিক ২ সে.মি. পর্যন্ত হয়ে থাকে। গায়ে-গতরে মাত্র এত্তোটুকুন পোকাটা গোঙ্গায় না।
ফুসফাস করে না। এমনকি কামড়ও দেয় না। তবুও এদের ধরা মোটেও সহজ কাজ নয়। শিকারী বা শত্রুর বিপদ টের পেলেই হয়েছে। বেগতিক দেখলে খুব দ্রুত গা ঢাকা দেয়ায় উস্তাদ। যেন এই আছে, এই নেই। কেবলমাত্র বিশেষজ্ঞ শিকারী সংগ্রহকারীরা পূর্ণ বয়স্ক পোকা ধরতে পারেন। তবে পানামা কোস্টারিকা এল সালভেদর আর মধ্য যুক্তরাষ্ট্রের গহীন জঙ্গলের অভয়ারণ্যে এদের ডেরা খুঁজে পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এরা সাধারণত যে জায়গায় বাস করে সেখানটা অনেকটাই খামারের মতো। এদের জীবন চক্রে ডিম, লার্ভা, পিউপা এবং পূর্ণাঙ্গ পর্যায় পর্ব রয়েছে। লাখ লাখ স্ক্যারাবের ডিম, লার্ভা, শুককিট জঙ্গলের গোপন স্থানে রক্ষিত থাকে।
সাধারণত উঁচু জঙ্গলে গাছের একদম আগায় গুঁড়ির ওপর স্ত্রী স্ক্যারাবরা ডজন ডজন ডিম পাড়ে। সে ডিম থেকে বের হয় লার্ভা। তারপর এর লার্ভাগুলো গাছের সঙ্গে লেগে থাকে। লার্ভারা গাছের গুঁড়ি থেকে তাদের খাবার হিসেবে সেলুলোজ সংগ্রহ করে এবং সিকমবায়োটিক প্রক্রিয়ায় খাদ্য হজম করে। লার্ভার পা থাকে না। লার্ভা অবস্থায় বছরে কয়েকমাস শিক্ষানবীস থাকতে হয়। লার্ভারা দিনের বেলায় সক্রিয় থাকে। বিশেষ করে বিকেলে বাইরে বের হয়।
রাতের বেলা গর্তে, শিকড়-বাকড়, কাণ্ড ও পাতার আড়ালে চলে যায়। কিছুদিন পরে এরা পিউপাতে পরিণত হয়। এবং মে মাসে যখন বর্ষা নামে তখন পূর্ণাঙ্গ স্ক্যারাবরা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে। প্রথমে এদের শরীর নরম ও মলিন থাকে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা বাদে এদের শরীর শক্তপোক্ত হয়ে উঠলে তখন এদের দিকে তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। যা দেখে মনে হতেই পারে সত্যিই এরা জুয়েল!
জুয়েল স্ক্যারাবদের বাজারে যেভাবে চড়া দামে বিক্রি করা হচ্ছে, পোকা শিকারীদের কারণে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যাবে না জুয়েল স্ক্যারাব। পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে সোনার চেয়ে দামি এই পোকা। জুয়েল স্ক্যারাবের বিলুপ্তির বিষয় নিয়ে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এখন বড়ই চিন্তিত।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।